থানায় সাধারণ ডায়েরি বা জিডি (জেনারেল ডায়েরি) একটি আইনগত প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি কোনো ঘটনা বা সমস্যার কথা থানায় লিখিতভাবে জানাতে পারেন। জিডি করা হয় সাধারণত এমন পরিস্থিতিতে যেখানে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি, তবে ঘটনার গুরুত্বের কারণে থানায় রিপোর্ট করার প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ, ফোন হারানো, গুরুত্বপূর্ণ নথি হারানো, হুমকি পাওয়া, বা কেউ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা জিডি করার জন্য প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
সূচীপত্র
নিচে থানায় জিডি করার ধাপগুলো দেওয়া হলো:
১. থানায় জিডি করার ধাপসমূহ
ক. থানায় যাওয়া
প্রথমে, আপনার নিকটস্থ থানায় যান। আপনি যে ঘটনাটি জিডি হিসেবে লিপিবদ্ধ করতে চান, তা আপনার স্থানীয় থানায় জানাতে হবে। প্রতিটি থানায় একটি ডিউটি অফিসার থাকে, যিনি জিডি গ্রহণ করেন।
খ. ঘটনার বিবরণ প্রস্তুত করুন
জিডি করার আগে আপনার অভিযোগ বা ঘটনার বিবরণ সঠিকভাবে প্রস্তুত করুন। এতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত:
- আপনার নাম, ঠিকানা, এবং যোগাযোগের তথ্য।
- ঘটনার সঠিক তারিখ ও সময়।
- ঘটনাটি কোথায় ঘটেছে এবং কী ঘটেছে তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
- যে কারণে আপনি থানায় জিডি করতে চান তা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করুন।
গ. ঘটনা লিখিতভাবে জমা দিন
অনেক থানায় আপনি নিজে থেকেই একটি লিখিত দরখাস্ত জমা দিতে পারেন, যেখানে আপনার ঘটনার সব বিবরণ থাকবে। কিছু থানায় লিখিত জিডি তৈরি করে দেওয়ার জন্য নির্ধারিত ফর্মও থাকতে পারে, যা আপনি পূরণ করে জমা দিতে পারেন।
উদাহরণস্বরূপ:
“আমি, মোঃ আলী, ২৩/০৯/২০২৪ তারিখে আমার মোবাইল ফোন হারিয়ে ফেলেছি। ফোনটি হারানোর সময় দুপুর ৩টার দিকে ঢাকা শহরের গুলশান এলাকায় ছিলাম। ফোনটির মডেল আইফোন ১২, এবং IMEI নম্বর ৩৫৮৩৯৪৮২০৩০৩৪৭। আমি থানায় একটি জিডি করতে চাই, যাতে ফোনটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়।”
ঘ. ডিউটি অফিসারের সাথে যোগাযোগ করুন
জিডির দরখাস্ত জমা দেওয়ার পর, থানার ডিউটি অফিসার বা ওসি (অফিসার ইন চার্জ) আপনার অভিযোগের গুরুত্ব পর্যালোচনা করবেন। তারা আপনার দরখাস্ত যাচাই করবেন এবং আপনার দেয়া তথ্য অনুযায়ী একটি জিডি নম্বর প্রদান করবেন।
ঙ. জিডি নম্বর সংগ্রহ করুন
জিডি জমা দেওয়ার পরে থানার পক্ষ থেকে আপনাকে একটি জিডি নম্বর প্রদান করা হবে। এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভবিষ্যতে আপনার অভিযোগ সংক্রান্ত কোনো আপডেট পেতে বা কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এই নম্বরটি প্রয়োজন হতে পারে।
২. অনলাইন জিডি করার প্রক্রিয়া
বর্তমানে অনেক দেশে অনলাইনে জিডি করার সুবিধাও রয়েছে। বাংলাদেশে কিছু থানায় অনলাইনে জিডি দায়ের করার পদ্ধতি রয়েছে। এর জন্য আপনি পুলিশ বিভাগের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে গিয়ে একটি অনলাইন ফর্ম পূরণ করে জিডি করতে পারেন।
ক. অনলাইন জিডি করার ধাপসমূহ
প্রথমে প্লে স্টোর থেকে ONLINE GD নামক অ্যাপটি ইনস্টল করতে হবে। এরপর নিজের মোবাইল নাম্বার ও মনে রাখার সুবিধা মতো পাসওয়ার্ড দিয়ে এবং অন্যান্য নির্দেশনা অনুসরণ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। এরপর নির্ধারিত ছকের তথ্যসমূহ পূরণ করে অনলাইন জিডির তথ্যাদি এন্ট্রি করতে হবে।
নিবন্ধন অপশনে গেলে মিলবে আরও চারটি অপশন। সেখানে আছে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন, পাসপোর্ট ও বিদেশি পাসপোর্ট। তবে আপাতত জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যে নিবন্ধন করা যাচ্ছে।
জাতীয় পরিচয়পত্রের অপশনে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার জন্ম তারিখ ও পরিচয়পত্র যাচাই করে ব্যবহারকারীর জেলা থানা ইউনিয়ন গ্রাম ও ঘটনার বিবরণ সংক্রান্ত তথ্য বিবরনী দিতে হবে।
অনলাইনে জিডি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ব্যবহারকারী পাবেন সার্ভিস কোড। অল্প সময়ের মধ্যেই অ্যাপস এর মাধ্যমে অনলাইনে কিউ-আর কোড সম্বলিত জিডির কপি সংগ্রহ ও মুদ্রণ করা যাবে। সফটওয়্যার ছাড়াও অনলাইন জিডি করা যাবে GD.POLICE.GOV.BD এইখানেও।
অনলাইন জিডি সুবিধাসহ ১৩টি ফিচার নিয়ে সিডিএমএস++ বাংলাদেশ পুলিশের নিজস্ব উদ্যোগে সিডিএমএস টেকনিক্যাল কমিটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে নির্মিত একটি অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার। সফটওয়্যারটির মোবাইল অ্যাপস ও ওয়েব সংস্করণ ব্যবহার করে সেবাগ্রহীতা ঘরে বসেই জিডিযোগ্য বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ রেকর্ড করতে পারবেন এবং এ বিষয়ে গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী আপডেট জানতে পারবেন।
৩. জিডির প্রয়োজনীয়তা
১. নথি বা সম্পদ হারানো: যদি আপনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ নথি, যেমন পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি হারিয়ে ফেলেন, তবে সেটি ট্র্যাক করার এবং আইনি প্রতিকার পেতে জিডি করতে পারেন।
২. মোবাইল বা অন্য প্রযুক্তি হারানো: আপনার মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ হারালে, তার IMEI নম্বরসহ থানায় জিডি করুন। এর মাধ্যমে ফোন ট্র্যাক করার সুযোগ থাকবে।
৩. নিখোঁজ ব্যক্তির জন্য: যদি কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ হন এবং তার অবস্থান সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকে, তবে থানায় একটি জিডি করতে হবে। এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ওই ব্যক্তির খোঁজ নিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
৪. হুমকি পাওয়া বা সুরক্ষার প্রয়োজন: যদি আপনি কারো কাছ থেকে হুমকি পান বা আপনার ব্যক্তিগত সুরক্ষার প্রয়োজন হয়, তবে থানায় জিডি করা যেতে পারে। এটি আপনার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
৪. উপসংহার
থানায় জিডি করা একটি সহজ এবং গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রক্রিয়া। এটি আপনার হারানো সম্পদ, নথি, বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষায় সহায়ক হতে পারে। জিডি করার মাধ্যমে আপনার সমস্যাটি পুলিশ বিভাগে আনুষ্ঠানিকভাবে রেকর্ড হয়ে যায়, যা প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে।
৫. সাধারণ ডায়েরি বা জিডি সম্পর্কে ৫টি জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
ক. সাধারণ ডায়েরি (জিডি) কী?
সাধারণ ডায়েরি বা জিডি হলো থানায় রিপোর্ট করার একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি কোনো ঘটনা বা সমস্যার কথা থানায় লিখিতভাবে জানান। জিডি সাধারণত অপরাধমূলক ঘটনার আগে বা কোনো সমস্যার আগাম সতর্কতা হিসেবে করা হয়। এটি কোনো অভিযোগ বা এফআইআর নয়, বরং একটি রেকর্ড যা পুলিশকে তথ্য জানাতে সাহায্য করে।
খ. কোন কোন পরিস্থিতিতে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়?
জিডি সাধারণত নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে করা হয়:
- মূল্যবান জিনিসপত্র বা নথি হারানো (যেমন পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল ফোন)।
- কারো কাছ থেকে হুমকি পাওয়া।
- কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ হওয়া।
- ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য পূর্ব সতর্কতা নেওয়া।
গ. সাধারণ ডায়েরি করার জন্য কী কী তথ্য প্রয়োজন?
জিডি করার জন্য নিম্নলিখিত তথ্য প্রয়োজন:
- আপনার নাম, ঠিকানা এবং যোগাযোগের নম্বর।
- ঘটনার তারিখ, সময় এবং স্থান।
- ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
- যদি কোনো প্রমাণ থাকে, যেমন হারানো জিনিসের বিবরণ বা নিখোঁজ ব্যক্তির তথ্য, সেটিও উল্লেখ করতে হবে।
ঘ. জিডি করতে কি কোনো খরচ হয়?
না, থানায় জিডি করতে কোনো অর্থপ্রদান করতে হয় না। এটি একটি বিনামূল্যের সেবা, যা পুলিশের পক্ষ থেকে সাধারণ নাগরিকদের জন্য সরবরাহ করা হয়।
ঙ. জিডি নম্বর কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পর থানার পক্ষ থেকে আপনাকে একটি জিডি নম্বর প্রদান করা হয়। এই নম্বরটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এটি একটি প্রমাণ হিসেবে কাজ করে এবং ভবিষ্যতে আপনার জিডি সম্পর্কিত আপডেট বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সহায়ক হয়।
আরও পড়ুন : দলিল রেজিস্ট্রেশন কেন করবেন, কিভাবে করবেন
মন্তব্য লিখুন