হোম দেশের আইন হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বন্টন করবেন কিভাবে
দেশের আইন

হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বন্টন করবেন কিভাবে

হিন্দু উত্তরাধিকার
বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে নারীদের উত্তরাধিকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে সীমিত। হিন্দু বিধবা স্ত্রীরা প্রায়শই কিছু সম্পত্তির অধিকার পায়, তবে তা পুরুষ উত্তরাধিকারীদের তুলনায় কম
শেয়ার করুন

বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন এবং উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইনি নীতিমালা নির্ধারণ করে। এই আইনটির মূল ভিত্তি প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু আইন এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইনি কাঠামোর সঙ্গে জড়িত। যদিও বাংলাদেশের অধিকাংশ আইন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের প্রেক্ষাপটে তৈরি, হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য ধর্মীয় আইন সংরক্ষিত রয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন বিশেষ করে দয়াভাগ (Dayabhaga) এবং মিতাক্ষরা (Mitakshara) নামক দুটি প্রথার ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যা মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন।

এই আইনের অধীনে হিন্দু সমাজে পুরুষ উত্তরাধিকারীদের সাধারণত বেশি অধিকার দেওয়া হয়। যদিও নারীদের জন্য কিছু অধিকার সংরক্ষিত রয়েছে, তবে বাস্তব ক্ষেত্রে নারীরা প্রায়শই বৈষম্যের শিকার হন। এছাড়া, ১৯৫৬ সালের ভারতীয় হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে নারীদের অধিক অধিকার দেওয়া হলেও, বাংলাদেশে এমন কোনও সংশোধন কার্যকর হয়নি, যার ফলে প্রথাগত ব্যবস্থার আওতায় নারীরা সম্পত্তিতে পর্যাপ্ত অধিকার পান না।

১. হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের হিন্দু উত্তরাধিকার আইন মূলত ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এবং ভারতীয় আইন কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে তৈরি। হিন্দু উত্তরাধিকার আইনটি মূলত দুইটি প্রধান পদ্ধতি দ্বারা পরিচালিত হয়: দয়াভাগ এবং মিতাক্ষরা। এই দুইটি প্রথার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো:

  • দয়াভাগ পদ্ধতি: এই পদ্ধতি বাংলার হিন্দুদের মধ্যে বেশি প্রচলিত। দয়াভাগ মতে, একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি বণ্টিত হয়। এই পদ্ধতিতে নারীরা কিছু অধিকার পায়, তবে তা পুরুষদের তুলনায় সীমিত।
  • মিতাক্ষরা পদ্ধতি: এই পদ্ধতি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত। মিতাক্ষরা মতে, পুরুষ সদস্যরা যৌথ পারিবারিক সম্পত্তিতে সহ-মালিক হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। এই পদ্ধতিতে নারীদের সম্পত্তির অধিকার প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়।

বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন কার্যকরী থাকলেও এতে উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন বা সংশোধনী আনা হয়নি। আইনটি পুরাতন প্রথার ওপর ভিত্তি করে হওয়ায় নারীদের অধিকার অবহেলিত থাকে।

দায়ভাগা পদ্ধতি বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা পূর্ববাংলায় প্রচলিত। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পত্তি বণ্টনের সময় নারীদের কিছু অধিকার দেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়। বর্তমান সময়ে এই আইনকে নারীর অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে আরও আধুনিক করার প্রয়োজন রয়েছে, যাতে নারী-পুরুষের মধ্যে সমান সম্পত্তি অধিকার নিশ্চিত হয়।

২. দায়ভাগা এবং মিতাক্ষরা পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য

দায়ভাগা এবং মিতাক্ষরা পদ্ধতির মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। মিতাক্ষরা পদ্ধতি অনুযায়ী, পুত্রেরা জন্মগতভাবে পিতার যৌথ পারিবারিক সম্পত্তির অংশীদার হয়, এবং পিতা জীবিত থাকাকালেও পুত্ররা সেই সম্পত্তির ওপর অধিকার পায়। তবে দায়ভাগা পদ্ধতিতে সম্পত্তি বণ্টন কেবল পিতার মৃত্যুর পরই ঘটে, এবং পুত্রেরা পিতার জীবদ্দশায় সম্পত্তির কোনও অংশীদার হয় না।

দায়ভাগা পদ্ধতিতে নারীদের কিছু অধিকার রয়েছে, যা মিতাক্ষরা পদ্ধতির তুলনায় উদার, তবে তা এখনও সীমিত। নারীরা সাধারণত সম্পত্তি ভোগ করার অধিকার পায়, কিন্তু তা হস্তান্তর করার ক্ষমতা থাকে না। মিতাক্ষরা পদ্ধতিতে নারীদের সম্পত্তি অধিকার প্রায়শই উপেক্ষিত হয়।

দায়ভাগা পদ্ধতির চ্যালেঞ্জ

দায়ভাগা পদ্ধতির মূল চ্যালেঞ্জ হলো এর মাধ্যমে নারীদের সম্পত্তি অধিকার এখনও সম্পূর্ণ সুরক্ষিত নয়। যদিও নারীদের কিছু অধিকার রয়েছে, তবু তারা পুরুষ সদস্যদের তুলনায় কম অংশ পায়। বিশেষ করে, বিধবারা শুধুমাত্র জীবদ্দশায় সম্পত্তি ভোগ করতে পারে, কিন্তু তা স্থায়ীভাবে নিজের নামে করতে পারে না বা বিক্রি করতে পারে না। কন্যাদের অধিকারও সীমিত, বিশেষ করে বিবাহিত কন্যারা সম্পত্তি অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।

৩. হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের মূল বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন বিশেষত কিছু নির্দিষ্ট দিক থেকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এই আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ:

ক. সম্পত্তির অধিকার

হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের আওতায় হিন্দু পুরুষদের দ্বারা অর্জিত সম্পত্তি এবং যৌথ পারিবারিক সম্পত্তি দুটি ধরণের হতে পারে। অর্জিত সম্পত্তি ব্যক্তিগত মালিকানার অন্তর্ভুক্ত, যা ব্যক্তি জীবদ্দশায় নিজের ইচ্ছামতো বণ্টন করতে পারেন। তবে যৌথ পারিবারিক সম্পত্তির ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারের নিয়ম বেশ জটিল এবং ঐতিহ্যগত প্রথার ওপর নির্ভরশীল।

পুরুষ উত্তরাধিকারীরা সাধারণত পারিবারিক সম্পত্তিতে বেশি অধিকার পায়। পুরুষ সদস্যরা যদি কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর বেঁচে থাকে, তাহলে তারা তার সম্পত্তির প্রধান উত্তরাধিকারী হয়। নারীরা, বিশেষত কন্যারা, কিছুক্ষেত্রে সম্পত্তির অধিকার পেলেও তা পুরুষদের তুলনায় কম।

খ. নারীর সম্পত্তি অধিকার

বাংলাদেশের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে নারীদের সম্পত্তি অধিকার সীমিত। বিশেষত, বিবাহিত নারী তার স্বামীর পরিবারের সম্পত্তির অধিকার থেকে প্রায়শই বঞ্চিত থাকে। তবে, কন্যারা পিতার সম্পত্তিতে কিছু অংশের অধিকার পেতে পারে, যদিও এই অধিকার পুরুষদের তুলনায় খুবই কম।

২০০৫ সালের ভারতীয় হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সংশোধনীতে নারীর সম্পত্তি অধিকার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে এই ধরণের কোন সংশোধনী হয়নি, ফলে নারীরা এখনও অনেক ক্ষেত্রে সম্পত্তি অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে।

গ. যৌথ পারিবারিক সম্পত্তি

হিন্দু পরিবারে যৌথ পারিবারিক সম্পত্তি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। যৌথ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সাধারণত যৌথ সম্পত্তির সহ-মালিক। বাংলাদেশে এই যৌথ পারিবারিক সম্পত্তি বণ্টনের জন্য সাধারণত পুরুষ সদস্যদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নারীরা সাধারণত যৌথ পারিবারিক সম্পত্তিতে সীমিত অধিকার পায়।

ঘ. উত্তরাধিকারী শ্রেণি

হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে উত্তরাধিকারী শ্রেণি নির্ধারণ করা হয় প্রথা ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে। সাধারণত উত্তরাধিকারীদের তিনটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:

  • প্রথম শ্রেণি: পুত্র, কন্যা, বিধবা স্ত্রী।
  • দ্বিতীয় শ্রেণি: নাতি-নাতনি, ভাইবোন, পিতামাতা।
  • তৃতীয় শ্রেণি: অন্যান্য আত্মীয়স্বজন, যারা প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত নয়।

প্রথম শ্রেণির উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তিতে সবচেয়ে বেশি অধিকার থাকে। যদি প্রথম শ্রেণির কোনও উত্তরাধিকারী না থাকে, তবে দ্বিতীয় শ্রেণির উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তির অধিকারী হয়।

ঙ. হিন্দু নারীর উত্তরাধিকার

বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে নারীদের উত্তরাধিকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে সীমিত। হিন্দু বিধবা স্ত্রীরা প্রায়শই কিছু সম্পত্তির অধিকার পায়, তবে তা পুরুষ উত্তরাধিকারীদের তুলনায় কম। বাংলাদেশে নারীদের সম্পত্তি অধিকার প্রসঙ্গে কিছু প্রথাগত ধারা রয়েছে, যা নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে।

** বিধবা স্ত্রীর অধিকার

বিধবা স্ত্রীর সম্পত্তি অধিকার বাংলাদেশে হিন্দু আইনের অন্যতম জটিল দিক। বিধবা স্ত্রীরা জীবিত থাকা পর্যন্ত স্বামীর সম্পত্তির ওপর অধিকার পায়, তবে তারা সম্পত্তি বিক্রি বা অন্য কাউকে প্রদান করতে পারে না। এই অধিকারকে “লাইফ ইন্টারেস্ট” বলা হয়, যা বিধবার মৃত্যুর পর স্বামীর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টিত হয়।

** কন্যার অধিকার

কন্যারা তাদের পিতার সম্পত্তিতে কিছু অধিকার পেতে পারে, তবে তা তাদের ভাইদের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশে কন্যাদের সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কন্যারা সাধারণত বিবাহিত হলে তাদের সম্পত্তি অধিকার আরও সীমিত হয়ে যায়, কারণ তারা বিবাহের পর স্বামীর পরিবারের অংশ হয়ে যায়।

** নারী অধিকার সংক্রান্ত আন্দোলন

বাংলাদেশে নারীদের সম্পত্তি অধিকারের জন্য বিভিন্ন আন্দোলন ও আলোচনা চলেছে। নারীবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু নারীদের সম্পত্তি অধিকারের বৈষম্য দূর করার জন্য আইন সংস্কারের দাবি উঠেছে। তবে, এখনও পর্যন্ত কোন উল্লেখযোগ্য আইন সংস্কার হয়নি, যার ফলে নারীদের সম্পত্তি অধিকার অনেক ক্ষেত্রে প্রথাগত আইনি কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

৪. দায়ভাগা আইনে উত্তরাধিকার : সপিন্ড, জীবনস্বত্ব ও স্ত্রীধন

দায়ভাগা হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলে প্রচলিত। এই পদ্ধতিতে উত্তরাধিকার এবং সম্পত্তির বণ্টনের বিশেষ নীতি রয়েছে। দায়ভাগা পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো পিতার মৃত্যুর পর সম্পত্তি বণ্টন করা এবং উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তা সমানভাবে বিতরণ করা। এই প্রথার অন্তর্গত কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এবং শর্ত রয়েছে, যেমন সপিন্ড (Sapinda), জীবনস্বত্ব (Life Interest) এবং স্ত্রীধন (Stridhan), যা উত্তরাধিকারের বিভিন্ন স্তর এবং অংশীদারিত্ব নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে।

ক. সপিন্ড (Sapinda) সম্পর্ক

সপিন্ড হিন্দু আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উত্তরাধিকার সম্পর্ক নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। সপিন্ড সম্পর্ক হলো রক্তের সম্পর্কের একটি বিশেষ ধারা, যা প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে। দায়ভাগা পদ্ধতিতে সপিন্ড সম্পর্কের ভিত্তিতে উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়।

  • সপিন্ড সম্পর্ক: যারা একসঙ্গে পিতৃ বা মাতৃসূত্রে পূর্বপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাদেরকে সপিন্ড বলা হয়। এটি সাধারণত ছয় প্রজন্ম পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। অর্থাৎ, পিতামহ বা মাতামহের ছয় প্রজন্মের মধ্যে উত্তরাধিকারীরা সপিন্ড হিসাবে বিবেচিত হয়।

দায়ভাগা পদ্ধতিতে সপিন্ড সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রথম শ্রেণীর এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তিতে তাদের অধিকার লাভ করেন। সপিন্ড সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হয়, উত্তরাধিকারের অধিকার তত বেশি হয়।

খ. জীবনস্বত্ব (Life Interest)

জীবনস্বত্ব হল এমন একটি অধিকার, যা একজন ব্যক্তির জীবদ্দশায় সম্পত্তি ব্যবহারের অধিকার প্রদান করে, তবে তিনি সেই সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারেন না। দায়ভাগা পদ্ধতিতে জীবনস্বত্ব বিশেষভাবে বিধবা স্ত্রী এবং মাতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

  • বিধবা স্ত্রীর জীবনস্বত্ব: বিধবা স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি ভোগ করতে পারেন। তবে, তার এই অধিকার শুধুমাত্র জীবদ্দশায় থাকে। তিনি এই সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবেন না এবং তার মৃত্যুর পর সেই সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে বণ্টিত হবে।
  • মায়ের জীবনস্বত্ব: মায়ের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। সন্তানের মৃত্যুর পর মা তার সম্পত্তিতে জীবনকালীন অধিকার পেতে পারেন। তবে তার মৃত্যুর পর সেই সম্পত্তি অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টিত হয়।

গ. স্ত্রীধন (Stridhan)

স্ত্রীধন হলো নারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যা তিনি বিয়ের সময়, উত্তরাধিকার সূত্রে বা উপহার হিসেবে পেতে পারেন। স্ত্রীধন নারীর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় এবং এতে নারীর পূর্ণ অধিকার থাকে।

  • স্ত্রীধনের প্রকারভেদ: স্ত্রীধনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে নগদ অর্থ, গহনা, জমি বা অন্য কোনও সম্পত্তি, যা বিয়ের সময় বা অন্য কোনও সময়ে নারীর কাছে প্রদান করা হয়েছে।
  • নারীর অধিকার: স্ত্রীধন নারীর নিজস্ব সম্পত্তি এবং এতে তার পূর্ণ অধিকার থাকে। তিনি এই সম্পত্তি যেকোনো সময় বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারেন। দায়ভাগা পদ্ধতিতে নারীর সম্পত্তি অধিকার সীমিত হলেও, স্ত্রীধন তার ব্যক্তিগত অধিকার হিসেবে সংরক্ষিত থাকে।

দায়ভাগা পদ্ধতিতে সম্পত্তির বণ্টন উত্তরাধিকারের তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত, যারা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে তাদের সম্পর্কের ভিত্তিতে অধিকার লাভ করে। এই শ্রেণীগুলো নিম্নরূপ:

** প্রথম শ্রেণী: সরাসরি উত্তরাধিকারী

প্রথম শ্রেণীতে মূলত মৃত ব্যক্তির সরাসরি রক্তের সম্পর্কের উত্তরাধিকারীরা অন্তর্ভুক্ত হন। এরা হল:

  • পুত্র ও কন্যা: পুত্ররা পিতার মৃত্যুর পর সরাসরি সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। কন্যারাও কিছু সম্পত্তির অংশ পায়, তবে পুরুষদের তুলনায় তাদের অধিকার সীমিত হতে পারে, বিশেষত যখন কন্যারা বিবাহিত হন।
  • বিধবা স্ত্রী: বিধবা স্ত্রীর জীবনকালে সম্পত্তি ব্যবহারের অধিকার রয়েছে, যাকে জীবনস্বত্ব বলা হয়। তবে তিনি সম্পত্তি বিক্রি বা অন্য কাউকে প্রদান করতে পারেন না।

** দ্বিতীয় শ্রেণী: নিকট আত্মীয়

দ্বিতীয় শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হয় নিকট আত্মীয়রা, যারা মৃত ব্যক্তির সন্তান বা স্ত্রী নয়, কিন্তু পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য:

  • ভাই-বোন: পুত্র বা কন্যা না থাকলে ভাই-বোনেরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। এ ক্ষেত্রে ভাইরা সাধারণত বড় অংশ পায়, তবে বোনেরাও অংশীদার হতে পারে।
  • মা: মৃত ব্যক্তির মা তার সন্তানের মৃত্যুর পর সম্পত্তির অধিকার পেতে পারেন। এই অধিকারও জীবদ্দশায় ভোগ করা হয়, যা জীবনস্বত্ব হিসেবে সীমিত।

** তৃতীয় শ্রেণী: দূরবর্তী আত্মীয়

তৃতীয় শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হন দূরবর্তী আত্মীয়রা, যেমন চাচা, মামা ইত্যাদি। যদি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কেউ বেঁচে না থাকে, তবে এই শ্রেণীর ব্যক্তিরা সম্পত্তির অংশীদার হয়।

৫. হিন্দু উত্তরাধিকার আইন কাদের জন্য প্রযোজ্য

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য প্রযোজ্য, তবে এর আওতায় আরও কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। সাধারণত এই আইন নিম্নলিখিত সম্প্রদায়গুলোর জন্য প্রযোজ্য:

  1. হিন্দু: হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য এই আইন প্রযোজ্য, যা তাদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন এবং উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো নির্ধারণ করে।
  2. বৌদ্ধ: বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্যও হিন্দু উত্তরাধিকার আইন প্রযোজ্য, কারণ ঐতিহাসিকভাবে হিন্দু এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে আইনগত নিয়মাবলী একসঙ্গে পরিচালিত হয়েছে।
  3. জৈন: জৈন ধর্মাবলম্বীরাও হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের আওতায় পড়েন। ভারতীয় আইন এবং উপমহাদেশের ঐতিহ্য অনুযায়ী, জৈনদের জন্য পৃথক কোনও উত্তরাধিকার আইন নেই, ফলে তাদের জন্য হিন্দু উত্তরাধিকার আইনই প্রযোজ্য।
  4. শিখ: শিখ সম্প্রদায়ের জন্যও এই আইন প্রযোজ্য। যদিও শিখ ধর্মের নিজস্ব কিছু প্রথা এবং রীতিনীতি রয়েছে, তাদের জন্য আলাদা কোনও উত্তরাধিকার আইন নেই। তাই, শিখদের উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়।

৬. কখন উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন

হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে সাধারণত উত্তরাধিকারীরা পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর পর সম্পত্তির অধিকার লাভ করেন। তবে কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে একজন উত্তরাধিকারী সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। এই বঞ্চনার কারণগুলো হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের বিভিন্ন শর্ত এবং প্রথাগত নিয়মের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত। নিচে হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কয়েকটি প্রধান কারণ উল্লেখ করা হলো:

ক. অপরাধমূলক কার্যকলাপ

একজন উত্তরাধিকারী যদি তার উত্তরাধিকারীর মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী হয় বা অপরাধমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে মৃত্যু ঘটায়, তাহলে সেই ব্যক্তি হিন্দু আইন অনুযায়ী সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন পুত্র যদি তার পিতার হত্যা করে, তবে সে তার পিতার সম্পত্তি লাভ করার অধিকার হারাবে। এ ধরণের পরিস্থিতিতে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাকে সম্পত্তির অধিকার থেকে সরিয়ে রাখা হয়।

খ. ধর্ম পরিবর্তন

হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে, ধর্ম পরিবর্তন একজন উত্তরাধিকারীকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে। যদি একজন হিন্দু ব্যক্তি তার ধর্ম পরিবর্তন করে এবং অন্য ধর্ম গ্রহণ করে, তবে তাকে উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতে পারে। বিশেষ করে, যদি কোনো ব্যক্তি ইসলাম বা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে, তবে সাধারণত তাকে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। তবে ধর্ম পরিবর্তনের ফলে একজন ব্যক্তি তার উত্তরাধিকার হারালেও, তার সন্তানরা এই অধিকার ধরে রাখতে পারে, যদি তারা হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়।

গ. ত্যাগপত্র (Disownment)

যদি একজন পিতা তার জীবদ্দশায় আইনগতভাবে তার সন্তানকে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চান, তবে তিনি ত্যাগপত্র বা Disownment প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেটি করতে পারেন। এই প্রক্রিয়ায় পিতা তার সন্তানকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘোষণা দিতে পারেন এবং তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে অন্য কাউকে মনোনীত করতে পারেন। তবে এই প্রক্রিয়াটি একটি আইনি ঘোষণা এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়।

ঘ. অসামাজিক বা অনৈতিক আচরণ

কিছু ক্ষেত্রে, একজন উত্তরাধিকারী যদি অসামাজিক বা অনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, যেমন মাদকাসক্তি, যৌন নির্যাতন, বা অন্য কোনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, তাহলে তাকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতে পারে। এ ধরণের পরিস্থিতিতে পরিবারের প্রধান ব্যক্তি বা আদালতের মাধ্যমে তাকে উত্তরাধিকারী তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।

ঙ. বিকলাঙ্গতা বা মানসিক অসুস্থতা

যদিও এটি সর্বজনীন নয়, তবে কিছু প্রথাগত সমাজে এবং পুরাতন হিন্দু আইনের অধীনে, যদি একজন উত্তরাধিকারী শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম হয়, তবে তাকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যেতে পারে। তবে এই নিয়মটি বর্তমানে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী আইনগতভাবে প্রযোজ্য নয়, এবং এটি একটি প্রথাগত চিন্তাধারা যা এখন অধিকাংশ দেশে পরিত্যক্ত হয়েছে।

চ. ইচ্ছাপত্র (Will) অনুযায়ী বঞ্চনা

হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে, যদি মৃত ব্যক্তি জীবদ্দশায় তার সম্পত্তি বণ্টনের জন্য একটি ইচ্ছাপত্র (Will) তৈরি করে যান, তাহলে সেই ইচ্ছাপত্রে নির্ধারিত উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তি পাবেন। যদি কোনো উত্তরাধিকারীকে ইচ্ছাপত্রে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়, তবে সে সেই সম্পত্তির ওপর কোনও অধিকার দাবি করতে পারবে না। এক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ইচ্ছাপত্রই সম্পত্তি বণ্টনের চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদান করবে।

ছ. বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে বঞ্চনা

কিছু ক্ষেত্রে, হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে একজন কন্যা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে যদি সে তার পিতার সম্মতি ছাড়া অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করে। এটি একটি প্রথাগত নিয়ম, যা বর্তমানে অধিকাংশ স্থানে কার্যকর নয়, তবে কিছু এলাকায় এখনও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী। বিবাহের পর অনেক ক্ষেত্রেই কন্যারা তাদের পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন, বিশেষত যদি তারা দূরের বা অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করে।

৭. হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নিচে এই চ্যালেঞ্জগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

৭.১ নারীর প্রতি বৈষম্য

বাংলাদেশের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে নারীদের সম্পত্তি অধিকার প্রায়শই সীমিত এবং বৈষম্যমূলক। যদিও হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী নারীদের কিছু সম্পত্তির অধিকার রয়েছে, কিন্তু পুরুষদের তুলনায় তারা অনেক ক্ষেত্রেই সম্পত্তি অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। নারীদের সম্পত্তি অধিকারের প্রশ্নে সমাজের প্রথাগত বিশ্বাস এবং আইনি কাঠামো তাদেরকে বৈষম্যের শিকার করে তোলে।

৭.২ আইনি সংস্কারের অভাব

বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে কোনও উল্লেখযোগ্য সংশোধনী বা পরিবর্তন আনা হয়নি, যা নারীদের সম্পত্তি অধিকারের জন্য একটি বড় বাধা। ১৯৫৬ সালে ভারতের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে যেসব সংস্কার আনা হয়েছিল, তার অনেকাংশই বাংলাদেশে কার্যকর হয়নি। এর ফলে নারীদের অধিকার এখনো ঐতিহ্যবাহী প্রথার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

৭.৩ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বাধা

হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের পাশাপাশি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বাধাও নারীদের সম্পত্তি অধিকার রক্ষায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিন্দু সমাজের প্রথাগত মানসিকতা, যা নারীদেরকে সম্পত্তি অধিকার থেকে দূরে রাখে, আইনি পরিবর্তনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। অনেক ক্ষেত্রে, নারীরা সম্পত্তির অধিকার থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত রাখে, কারণ সামাজিকভাবে এটি প্রাধান্য পায়।

৮. উপসংহার

বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি ব্যবস্থা, যা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পত্তির বণ্টন এবং উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করে। এই আইনটি মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলের হিন্দু আইন থেকে উদ্ভূত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই আইন বহাল রাখা হয়েছে, যদিও সময়ের সাথে কিছু পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন মূলত হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ এবং জৈন সম্প্রদায়ের লোকদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারের নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করে। এই আইন অনুযায়ী, পুরুষ এবং মহিলাদের সম্পত্তি অধিকার এবং বণ্টন পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। তবে, ঐতিহ্যগত হিন্দু প্রথা ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে পুরুষ উত্তরাধিকারীদের প্রতি প্রায়শই অধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে।

 

(ফলো করুন আমাদের Google News, Facebook এবং Twitter পেজ)

সাবস্ক্রাইব করুন
সাবস্ক্রাইব
আইন সমাচার থেকে সরাসরি সর্বশেষ আপডেট, টিউটোরিয়াল পেতে আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।
শেয়ার করুন
লিখেছেন
আইন সমাচার - প্রধান প্রতিবেদক

আইন ও বিচার বিষয়ে এ বাংলা ব্লগ চালু করার উদ্দেশ্য হলো, সাধারণ মানুষকে প্রয়োজনীয় আইন সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা। আইন ও বিচার সম্পর্কিত যে কোন ধরনের তথ্য, ব্লগ আপডেট সবসময় পাঠকের সামনে তুলে ধরাই আইন সমাচার এর মূল লক্ষ্য। আমরা নিরপেক্ষ তথ্য সরবারহের জন্য সম্পূর্ণই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিনামূল্যে আইন বিষয়ক সমস্যার সমাধান, সেবা, সহায়তা করাও আ্রইন সমাচার এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

মন্তব্য লিখুন

Leave a Reply

সাবস্ক্রাইব করুন
সাবস্ক্রাইব
আইন সমাচার থেকে সরাসরি সর্বশেষ আপডেট, টিউটোরিয়াল পেতে আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।