হোম দেশের আইন আপনার কি সাকসেশন সার্টিফিকেট প্রয়োজন? কোথায় পাবেন?
দেশের আইন

আপনার কি সাকসেশন সার্টিফিকেট প্রয়োজন? কোথায় পাবেন?

সাকসেশন সার্টিফিকেট
শেয়ার করুন

মানুষের জীবন চক্রের একটি অনিবার্য সত্য হলো মৃত্যু। মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি ও দায়-দেনা উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টনের প্রয়োজন দেখা দেয়। এই বণ্টনের ক্ষেত্রে আইনি বৈধতা প্রদান ও উত্তরাধিকার নির্ধারণের জন্য প্রয়োজন হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি— সাকসেশন সার্টিফিকেট। বাংলাদেশে সাকসেশন সার্টিফিকেট সংক্রান্ত বিধানসমূহ মূলত The Succession Act, 1925 অনুযায়ী পরিচালিত হয়।

এই ব্লগে সাকসেশন সার্টিফিকেটের সংজ্ঞা, প্রাপ্তির প্রক্রিয়া, সংশ্লিষ্ট আইন, আদালতের ভূমিকা, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, এবং এর ব্যবহারিক গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

সূচীপত্র

সাকসেশন সার্টিফিকেট কী?

সাকসেশন সার্টিফিকেট (Succession Certificate) হলো এমন একটি আইনি দলিল, যা মৃত ব্যক্তির চলমান সম্পত্তি (যেমন ব্যাংক ব্যালান্স, শেয়ার, পেনশন, বীমা ইত্যাদি) হস্তান্তরের জন্য নির্ধারিত ব্যক্তি বা উত্তরাধিকারীকে প্রদান করা হয়। এটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সামনে প্রমাণ করে যে প্রাপকই প্রকৃত দাবিদার।

প্রযোজ্য আইন: The Succession Act, 1925

বাংলাদেশে সাকসেশন সার্টিফিকেট সংক্রান্ত কার্যক্রম The Succession Act, 1925 অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এই আইনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • Section 370: এই ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তার ঋণ বা চলমান সম্পত্তি দাবি করতে হলে সাকসেশন সার্টিফিকেট প্রাপ্তি প্রয়োজন।
  • Section 372: এই ধারা নির্ধারণ করে, কীভাবে সাকসেশন সার্টিফিকেটের আবেদন করা যাবে।
  • Section 381: এই ধারা অনুযায়ী, একবার সাকসেশন সার্টিফিকেট জারি হলে তার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তিতে দাবি স্থাপন বৈধ বলে গণ্য হয়।

কারা আবেদন করতে পারবেন?

সাধারণত, মৃত ব্যক্তির:

  • বৈধ স্ত্রী বা স্বামী
  • সন্তান বা পুত্রবধূ
  • পিতা-মাতা
  • ভাই/বোন

— এই ধরনের নিকট আত্মীয়গণ আবেদন করতে পারেন। আবেদনকারীকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির দাবিদার।

প্রয়োজনীয়তা

সাকসেশন সার্টিফিকেট সাধারণত প্রয়োজন হয় নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে:

  1. ব্যাংক একাউন্ট বা ফিক্সড ডিপোজিট হস্তান্তর
  2. পেনশন, বীমা বা প্রভিডেন্ট ফান্ড উত্তোলন
  3. শেয়ার বা সিকিউরিটিজ ট্রান্সফার
  4. কোনো ঋণ বা পাওনা আদায়ের জন্য
  5. কোনো বিবাদমুক্ত উত্তরাধিকার প্রমাণের জন্য

 আবেদন প্রক্রিয়া

১. আবেদন প্রস্তুতি

প্রথম ধাপে, আবেদনকারীকে একটি লিখিত আবেদন তৈরি করতে হয় যেখানে উল্লেখ থাকবে:

  • মৃত ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, মৃত্যুর তারিখ
  • তার সম্পত্তি ও দেনার বিবরণ
  • আবেদনকারীর পরিচয় ও দাবির ভিত্তি
  • অন্য সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের নাম

২. আবেদনপত্র দাখিল

আবেদনটি সংশ্লিষ্ট জেলা জজ আদালতে (District Judge Court) দাখিল করতে হয়। এখানে একটি নির্ধারিত ফি জমা দিতে হয় (কোর্ট ফি) এবং সঠিক কাগজপত্র সংযুক্ত করতে হয়।

৩. নোটিশ জারি

আবেদনের প্রাথমিক যাচাইয়ের পর আদালত একটি পাবলিক নোটিশ জারি করে (সাধারণত স্থানীয় পত্রিকায়) যাতে অন্য কোনো দাবিদার থাকলে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে (সাধারণত ৪৫ দিন) আপত্তি জানাতে পারেন।

৪. শুনানি

আপত্তি না থাকলে বা আপত্তি নিষ্পত্তির পর আদালত শুনানির মাধ্যমে আবেদনকারীর দাবির সত্যতা যাচাই করে।

৫. সার্টিফিকেট ইস্যু

সবকিছু যাচাই-বাছাই শেষে আদালত সাকসেশন সার্টিফিকেট প্রদান করে এবং সেটি আবেদনকারীর নামে ইস্যু হয়।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

সার্টিফিকেটের আবেদনপত্রের সঙ্গে সাধারণত যেসব নথি জমা দিতে হয়:

  • মৃত ব্যক্তির মৃত্যু সনদ (Death Certificate)
  • আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র
  • পরিবারের তালিকা (Family tree / genealogy)
  • সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির প্রমাণ (যেমন ব্যাংক স্টেটমেন্ট, পেনশন কাগজ, শেয়ারের কপি)
  • অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের সম্মতি (যদি থাকে)

আপত্তি ও বিরোধ নিষ্পত্তি

যদি একাধিক ব্যক্তি একই সম্পত্তির উপর দাবিদার হন, তাহলে আদালত সকল পক্ষকে শুনে প্রমাণসহ সিদ্ধান্ত দেয়। আদালত প্রয়োজন মনে করলে ডিএনএ পরীক্ষা, মৌখিক সাক্ষ্য বা দলিল যাচাই করতে পারে।

সাকসেশন সার্টিফিকেট বনাম উত্তরাধিকার সনদ

বিষয়ের নামসাকসেশন সার্টিফিকেটউত্তরাধিকার সনদ
ইস্যুকারীজেলা জজ আদালতস্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা
বৈধতাআইনগতভাবে অধিক শক্তিশালী ও আদালতের স্বীকৃতসহায়ক দলিল, কিন্তু আদালতের স্বীকৃতি নয়
উদ্দেশ্যসম্পত্তি দাবি ও হস্তান্তরের জন্যপরিবারিক পরিচয় ও উত্তরাধিকার নির্ধারণ
প্রয়োগব্যাংক, বীমা, পেনশন, শেয়ার ইত্যাদির ক্ষেত্রেসাধারণ পরিচয়পত্র বা সহায়ক তথ্য হিসেবে

আদালতের বিবেচ্য বিষয়সমূহ

আদালত নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত প্রদান করে:

  • আবেদনকারীর ও মৃত ব্যক্তির সম্পর্ক
  • সম্পত্তির প্রকৃতি ও পরিমাণ
  • অন্যান্য সম্ভাব্য দাবিদারদের অবস্থান
  • আপত্তি থাকলে তার যৌক্তিকতা

সার্টিফিকেটের বৈধতা ও সীমাবদ্ধতা

একবার আদালত সাকসেশন সার্টিফিকেট প্রদান করলে, সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির বিষয়ে দাবিদার বৈধ বলে গণ্য হয়। তবে এটি শুধুমাত্র চলমান সম্পত্তির (movable property) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যদি অচল সম্পত্তি (immovable property) নিয়ে বিরোধ থাকে, তাহলে পৃথকভাবে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত মামলা করতে হতে পারে।

সময়কাল ও ব্যয়

সাধারণত আবেদন থেকে সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য সময় লাগে প্রায় ৩-৬ মাস, যদি কোনো আপত্তি না থাকে। ব্যয় নির্ভর করে আইনজীবীর ফি, কোর্ট ফি ও অন্যান্য ডকুমেন্ট প্রস্তুতির ওপর।

ব্যবহারিক উদাহরণ

উদাহরণ ১:

রফিকুল ইসলাম নামে একজন ব্যক্তি হঠাৎ করে মৃত্যুবরণ করেন। তার একমাত্র ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৮ লাখ টাকা ছিল। তার স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ টাকা ছাড় করতে বলল সাকসেশন সার্টিফিকেটের অনুলিপি। তখন তার স্ত্রী স্থানীয় আইনজীবীর সহায়তায় আদালতে আবেদন করে ও ৩ মাসের মধ্যে সাকসেশন সার্টিফিকেট অর্জন করে।

উদাহরণ ২:

একজন পিতা তার মৃত্যুর আগে কোনো উইল তৈরি করেননি। মৃত্যুর পর তার তিন সন্তান সম্পত্তির দাবিদার হয়। কিন্তু একজন সন্তান নিজেকে একমাত্র উত্তরাধিকার বলে দাবি করে সাকসেশন সার্টিফিকেট চায়। বাকি দুই ভাই আপত্তি করে। তখন আদালত উভয় পক্ষকে শুনে ও যাচাই করে প্রকৃত দাবিদার নির্ধারণ করে।

উপসংহার

সাকসেশন সার্টিফিকেট হচ্ছে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দাবির একটি আইনগত স্বীকৃতি। এটি না থাকলে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি হস্তান্তর প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘায়িত হতে পারে। তাই, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও আইনজীবীর সহায়তায় যথাসময়ে এই সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

The Succession Act, 1925https://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-138.html

জিজ্ঞাসিত প্রশ্নত্তোর(FAQ)

প্রশ্ন ১: সাকসেশন সার্টিফিকেট কী এবং এটি কেন প্রয়োজন?

উত্তর:
সাকসেশন সার্টিফিকেট হলো একটি আইনি দলিল যা প্রমাণ করে যে মৃত ব্যক্তির চলমান সম্পত্তি (যেমন ব্যাংক ব্যালান্স, বীমা, পেনশন, শেয়ার ইত্যাদি) গ্রহণের জন্য আবেদনকারী বৈধ দাবিদার। এটি মূলত উত্তরাধিকারীদের নামে সম্পত্তি হস্তান্তর করার পূর্বশর্ত হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি ছাড়া অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সরকারি সংস্থা সম্পত্তি ছাড় করতে রাজি হয় না।

প্রশ্ন ২: বাংলাদেশে কে বা কারা সাকসেশন সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে পারেন?

উত্তর:
মৃত ব্যক্তির নিকট আত্মীয় যেমন:

  • স্ত্রী বা স্বামী
  • সন্তান
  • পিতা-মাতা
  • ভাই বা বোন
    — এই ধরনের ব্যক্তি যারা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির দাবিদার, তারাই আদালতে সাকসেশন সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে পারেন।

প্রশ্ন ৩: সাকসেশন সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য কোথায় আবেদন করতে হয় এবং কী কী কাগজপত্র লাগে?

উত্তর:
আবেদনটি জেলা জজ আদালতে (District Judge Court) করতে হয়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে:

  • মৃত ব্যক্তির মৃত্যু সনদ
  • আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র
  • সম্পত্তির প্রমাণপত্র (যেমন ব্যাংক স্টেটমেন্ট)
  • পারিবারিক বিবরণ
  • অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের সম্মতির কপি (যদি থাকে)

প্রশ্ন ৪: সাকসেশন সার্টিফিকেট পাওয়ার পুরো প্রক্রিয়ায় কত সময় লাগে?

উত্তর:
সাধারণত আপত্তি না থাকলে ৩ থেকে ৬ মাস সময় লাগে। তবে যদি অন্য কেউ আপত্তি জানায় বা কাগজপত্রে অস্পষ্টতা থাকে, তাহলে সময় আরও বেশি লাগতে পারে। সময়কাল নির্ভর করে আদালতের কার্যক্রম ও প্রক্রিয়ার জটিলতার ওপর।

প্রশ্ন ৫: সাকসেশন সার্টিফিকেট কি অচল সম্পত্তির (জমি বা ভবন) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য?

উত্তর:
না, সাকসেশন সার্টিফিকেট কেবলমাত্র চলমান সম্পত্তি (movable property) যেমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, শেয়ার, পেনশন ইত্যাদির জন্য প্রযোজ্য। অচল সম্পত্তি (immovable property) যেমন জমি, ভবন ইত্যাদির জন্য উত্তরাধিকার নির্ধারণের জন্য ভিন্ন আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, যেমন উত্তরাধিকার মামলা বা জমি নামজারি আবেদন।

(ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ)

শেয়ার করুন
লিখেছেন
আইন সমাচার - প্রধান প্রতিবেদক

আইন ও বিচার বিষয়ে এ বাংলা ব্লগ চালু করার উদ্দেশ্য হলো, সাধারণ মানুষকে প্রয়োজনীয় আইন সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা। আইন ও বিচার সম্পর্কিত যে কোন ধরনের তথ্য, ব্লগ আপডেট সবসময় পাঠকের সামনে তুলে ধরাই আইন সমাচার এর মূল লক্ষ্য। আমরা নিরপেক্ষ তথ্য সরবারহের জন্য সম্পূর্ণই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিনামূল্যে আইন বিষয়ক সমস্যার সমাধান, সেবা, সহায়তা করাও আ্রইন সমাচার এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

মন্তব্য লিখুন

Leave a Reply